বাংলাদেশে এখন জনগণের জীবন
বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন সমকালে
|
![]() শাসক শ্রেণির দক্ষিণপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো বামপন্থিদের এই প্রতিরোধহীনতার কারণে টিকে থাকলেও তাদের জন্য এখন সংকট তৈরি হয়েছে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট দ্রুত তাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করছে। বেপরোয়া হয়ে তারা যেভাবে দেশ শাসন করছে এটা যে তারই পরিণতি, এতে সন্দেহ নেই। ১৯৭২ সাল থেকে এ দেশে ব্যবসায়ী বুর্জোয়ারা শাসক শ্রেণির সব থেকে শক্তিশালী অংশে পরিণত হওয়ার কারণে দেশে লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, ঘুষ, সন্ত্রাস ইত্যাদি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সরকার উন্নয়নের নামে অনেক প্রচারণা করে থাকে। কিন্তু এই 'উন্নয়ন'ও এখন দুর্নীতির একটি ক্ষেত্রে এমনভাবে পরিণত হয়েছে, যাতে মাত্র কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এক সভায় বলেছেন, উন্নয়নের নামে যা ব্যয় হয় তার ৪০ শতাংশ প্রকৃত উন্নয়নের কাজে লাগে, বাকি ৬০ শতাংশ চুরি হয়। এই চুরি কারা করে এ নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। বিষয়টির ওপর আমি অন্যত্রও লিখেছি। কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রামে নিজেদের দলীয় এক সভায় দলের লোকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, আপনারা যারা অবৈধভাবে টাকা-পয়সা বানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্ষমতায় না থাকে তাহলে আপনাদের নিজেদের টাকাপয়সা নিয়ে পালাতে হবে! এটা যে কোনো দলের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রথম সারির নেতা ও সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্য সভায় বলতে পারেন, এটা কোনো দিন চিন্তা করাও যেত না। কিন্তু পরিস্থিতির এখন এত অবনতি হয়েছে যে, এ ধরনের কথা দেশের লোককে শুনতে হলো। দেশের জনগণের যদি প্রতিরোধের শক্তি থাকত, বিশেষত বামপন্থি দলগুলো যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো হিসাবযোগ্য শক্তি হতো, তাহলে শাসক দলের পক্ষে এ ধরনের প্রকাশ্য বক্তব্য প্রদান অসম্ভব হতো। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় যা সম্ভব হতো না, এখন দেশে নৈরাজ্যিক অবস্থা বিরাজ করায় এটা সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়টি উপেক্ষা করার মতো নয়। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নিকৃষ্টতম অংশ যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে এটা লক্ষ্য করার মতো। এই নিকৃষ্ট অংশ হলো দেশের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল দল ও শক্তিগুলো। তারা এখন নিজেদের যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করছে। শুধু তারাই নয়, শাসক দলের লোকেরাও তাদের এই শক্তি বৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে তাদের সঙ্গে এখন যেভাবে সমঝোতা করছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একেবারেই হওয়ার কথা নয়। দেশে এ ধরনের সংগঠন শুধু জামায়াতে ইসলামীই নয়, ইসলামী শাসনতন্ত্র, খেলাফতে মজলিস এবং সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে হেফাজতে ইসলাম এখন বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই পরিস্থিতির প্রকৃত ক্ষতিকর দিকের প্রতি যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে এটা জঙ্গি তৎপরতা নামে যে উৎপাত এখন দেখা যাচ্ছে, তার থেকেও রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। জনগণ ও বিরোধী শক্তিগুলোর ওপর নির্যাতন ব্যবসায়ী বুর্জোয়া শাসিত ব্যবস্থায় এক স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের নিজেদের শক্তি টিকিয়ে রাখা অর্থাৎ নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যও কিছুটা গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণকে দেওয়া দরকার। কারণ, তাদের শোষণ-নির্যাতনের দ্বারা তারা জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের বাষ্প সৃষ্টি করে, তার বহিঃপ্রকাশ দমন-পীড়নের দ্বারা বন্ধ রাখলে শেষ পর্যন্ত সেটা শাসক শ্রেণি ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য মহাবিপদের শর্ত তৈরি করে। বাংলাদেশে যেভাবে আজ শাসনকর্ম, অর্থনীতি, উন্নয়ন কাজ ইত্যাদি পরিচালিত হচ্ছে, তাতে এই বিপদ বিষয়ে কোনো ধারণা তাদের আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু অন্য দেশের এবং আশপাশ দেশের ইতিহাসেও দেখা গেছে যে, অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত এই বিপদ থেকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও রক্ষা পায় না। প্রকৃতির যেমন কিছু নিয়ম আছে, তেমনি রাজনীতিরও নিয়ম আছে। প্রকৃতির নিয়মের ঊধর্ে্ব যেমন কেউ নেই, তেমনি এই রাজনৈতিক নিয়মেরও ঊধর্ে্ব কেউ নেই। কাজেই রাজনীতিতে এর পরিণতি কোনো কোনো কারণে বিলম্বিত হতে থাকলেও এর হাত থেকে উদ্ধার কারও নেই। নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি শাসক শ্রেণি ও শাসক দলের ক্ষেত্রে যেমন বিপজ্জনক, তেমনি তা বিপজ্জনক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে। কারণ এই পরিস্থিতিতে সবকিছুই মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে সেই পরিস্থিতিতে শোষণ-নির্যাতন থাকলেও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া ও শক্তিশালী করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নৈরাজ্য যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য এই সংগ্রামের সম্ভাবনা বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় জনগণের জীবন অতিষ্ঠ ও নানা সমস্যায় জর্জরিত। নিরুপায় জনগণের এখন এক দিশেহারা অবস্থা। এই দিশেহারা পরিস্থিতির মধ্যেই জনগণকে শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। ২২.৫.২০১৭ সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল |