অনালোকে চন্দ্রমুখী সূর্যমুখীর আলো
বাহার উদ্দিন
|
![]() ধুবুলিয়া থেকে বাঁদিকে এগিয়ে, দূরে আরো দূরে গ্রাম-ছোঁয়া লোকালয় জলঙ্গীর তীরবর্তী ‘হরিণডাঙায়’ চিরসাথী স্বাতীকে নিয়ে ঢুকে পড়ছি। রেলশেড, পরিত্যক্ত কোয়ার্টার দেখে বোঝা যাচ্ছে, পাশেই কোনো স্টেশন। বাড়িঘরের চেহারা অনায়াসে বলে দিচ্ছে, জনবিন্যাস মূলত একমুখী হলেও সুর তার মিশ্র, বহুমুখী। দারিদ্র্য আছে, আছে ছন্নছাড়া বৈষম্য, আছে অপার তৃষ্ণা নিবারণের অভিপ্রায়। তৃষ্ণাটা কীসের? গরিবী বর্জন আর বিদ্যার্জনের মীমাংসিত সিদ্ধান্তের। এরকম ছবি শুধু কি এই এলাকায়? না। পশ্চিমবঙ্গের সব প্রান্তে, সব গঞ্জে, অনগ্রসর সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে মুসলিম জনশক্তির আবৃত চত্বরেও একই চিত্র। মুসলিমদের কথা আলাদাভাবে বলার কারণ—তাঁরা বাংলার জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। আরো একটু স্পষ্ট ভাষায়, বৃহত্তর তথ্য পেশ করে প্রশ্ন তোলা দরকার- উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের মোট জনবল আর বঙ্গের মুসলিম জনবিস্তৃতির ফারাক কতটা? বেশি না কম? যদি যত্সামান্য হয়, তাহলে এত বড় সংখ্যা থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃতির অঙ্গনে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসায়ও তাঁদের প্রতিনিধিত্ব কেন আজো নগণ্য? দায়ী কে? নিজেদের চিন্তার দীনতা না সমষ্টির অনুদার দৃষ্টি? কারণ যাই হোক না কেন, কারণের উত্স রয়েছে, এখনো এখানে-ওখানে তার স্রোত বইছে। প্রসঙ্গত আমাদের চোখে ভাসে সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী এমন এক দুঃসহ অধ্যায় যখন ব্রিটিশ আমলা ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারকে বিশদ সমীক্ষা সামনে রেখে নিঃসংশয়ে বলতে হয়েছিল (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস: স্ট্যাটিসকাল অ্যাকাউন্টস অব বেঙ্গল) করুণ অবস্থার পরিবর্তন দরকার, না হলে সামাজিক ভারসাম্য আসবে না, ক্ষোভ প্রশমিত হবে না, সন্ত্রাসের পথ বেছে নেবে পুনরুত্থানের দুঃসাহস। সিদ্ধান্ত আর পরামর্শে মুসলিমদের যে-চিত্র তুলে ধরেছিলেন হান্টার, তা কি অতিরঞ্জিত, পক্ষপাতদুষ্ট? ব্রিটিশের বিভাজন নীতির আরেক কৌশল মাত্র? বাংলাদেশে, এখানেও এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন অনেকেই, এখনো খোঁজা হচ্ছে অক্সফোর্ড আর হার্ভার্ডের গবেষণায়। আবার কেউ কেউ পিছিয়ে পড়ার ইতিহাসের আড়ালের বৃত্তান্তকে বড় করে দেখিয়ে আজও অতীতের, এমনকী হালের সামাজিক গলদকে ঢেকে রাখতে ইচ্ছুক। অপ্রত্যাশিত হলেও এটাও এক বাস্তব। একথা বলতে বলতে কয়েকবছর আগের একটি দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। মনমোহন সিং তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রের নির্দেশে সাচার কমিটি মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খতিয়ে দেখে বলল, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায়ের সার্বিক চিত্র অতিশয় হতাশাজনক। গুজরাটের চেয়েও ঢের বেশি দীর্ণ, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ। ওই সময় রাজনীতির কোনো কোনো মুখ ঐতিহাসিক কারণের আশ্রয় নিয়ে সাফাই গাইতে শুরু করলেন, গবেষকদের একাংশও এগিয়ে এলেন তাঁদের সমর্থনে। কিন্তু কোনো স্পষ্টবাদী সত্যান্বেষীও বললেন না যে, ব্রিটিশের ভারত দখলের প্রায় আড়াইশ’ আর স্বাধীনতার এতদিন পরেও যে সমাজ রুগ্ণ, হীনম্মন্যতা আর বৈষম্যবোধে আক্রান্ত—তার জন্য দায়ী বৃহতের সাম্প্রদায়িক উদাসীনতা বা উদাসীন সাম্প্রদায়িকতা। প্রকারান্তরে একথাটিই, ১৯০৫ সালের পর থেকে বারবার বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ: বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও স্বাদেশিকতায় দূষণের উগ্রতা দেখে শঙ্কিত কবিকে বলতে হয়েছে—বৃহত্তর সমাজের একাংশ যদি পিছিয়ে পড়ে, তাদের এগিয়ে যাবার সম্বল জোগাতে হবে, তারা যদি ন্যায্য ভাগ দাবি করে— তাহলে দাবির সে অধিকার স্বীকার করতেই হবে, এটাই নিরপেক্ষ নির্বিশেষের নির্দেশ। কবির সতর্ক উচ্চারণকে সেদিন আমল দেয়নি অখণ্ড বাংলা, বরং বিভাজিত হতে হতে মর্মান্তিক পরিস্থিতি তৈরি করলো। জাতির বাঙময় আর রাজনীতির যে-অংশ একদিন বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে রাস্তায় নেমেছিল, তারাও স্বাধীনতার প্রত্যুষে বাংলাভাগের ন্যায্যতা মেনে নিয়ে বুঝিয়ে দিলো বিভাজিত সত্তাই আমাদের রাষ্ট্রিক নিয়তি। কী নৃশংস, আবার সদাশয় এ সিদ্ধান্ত! পূর্ববঙ্গে দ্রুত মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটলো, ঢাকা-খুলনা-চট্টগ্রাম শহরের আদল ছেড়ে নগর হয়ে উঠলো, এসব নগরের, নানা প্রান্তের বাধ্যতামূলক গৃহত্যাগীদের শূন্যস্থান পূরণ করলো এপার থেকে ওপারে আশ্রিত শিক্ষিত উদ্বাস্তুরা। আর তখনই যে ঘুণপোকা ঢুকে পড়লো অস্তিত্ব আর চিন্তায়, যে অতীতমুখী অসুখ এ বঙ্গের মুসলিমদের গ্রাস করলো, সে সবের কবল থেকে আজো তাদের পুরোপুরি নিস্তার নেই। এও এক আরোপিত, কিছুটা স্বনির্বাচিত অবরোধ। তবে, বিলম্বিত হলেও আশার কথা, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান আর ভারতীয় গণতন্ত্রের বহুত্ববাদী আশ্বাসে এ বঙ্গের মুসলিমদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে, ক্ষীণদেহী মধ্যবিত্ত, গ্রামীণ সমাজও বুঝতে আর ভাবতে শিখলো যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা একটি মিথ্যা, জন্ম যেহেতু এদেশে, অতএব এখানেই মৃত্যুহীন রাস্তা খুঁজতে হবে, যেখানে অন্ধকার, সেখানেই আলো ছড়াতে হবে। চিত্ততাড়িত এ আগ্রহ তার তৃণস্তরকে, মননের নানা স্বর আর প্রক্রিয়াকেই ইদানীং ঘনঘন স্পর্শ করছে। শুভ লক্ষণ। এ লক্ষণেরই উজ্জ্বল একটি ছবি আমরা নদীয়ার হরিণডাঙায় দেখে এলাম। বিশেষ কোনো ব্যক্তি অথবা পরিবারের প্রশস্তি করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রতিভা কীভাবে ব্যক্তিকতাকে অতিক্রম করে, কীরকম আত্মবিশ্বাস আর আত্মতার নির্মাণকে সমষ্টির সেবায় বিলিয়ে দেবার পাশাপাশি নিজের পারিবারিক কাঠামোকেও সমানভাবে আলোকিত করে তোলে—একথাই বলতে চাইছি। এ গ্রামে স্থায়ীভাবে, আমৃত্যু বাস করতেন শুকুর আলি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্নাতক। দেশভাগ, নকশাল আমল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী। স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁর সহসঙ্গীও শিক্ষিত, স্কুলে চাকরি পেয়েও মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে রইলেন। রত্নগর্ভা, সহজ-সরল মহিলা। তাঁদের তিন মেয়ে, দুই ছেলে। বড়ো মেয়ে ডাক্তার, মেজো শামসুনেছা বহরমপুর কলেজের দর্শনের অধ্যাপক, পরের জন কামরুননেছা ইংরেজির অধ্যাপক, কলকাতার কাছাকাছি এক অভিজাত মহাবিদ্যালয়ের। ছোটো ছেলে আজনারুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোলের অধ্যাপক। সবার শীর্ষে যে ছেলে তিনি ইঞ্জিনিয়ার। গ্রামীণ পরিবারে এরকম উত্তরণ সচরাচর দেখা যায় না। এঁরা হাঁটতে হাঁটতে, সাইকেল চালিয়ে ছুটতে ছুটতে স্কুলে গেছেন, স্কুল থেকে কৃষ্ণনগর কলেজে, যাতায়াত ট্রেনে অথবা বাসে। কেউ পড়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ-বা কল্যাণীতে, কল্যাণী থেকে একজনকে বইয়ের খোঁজে ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে প্রায়ই যেতে হতো, এহেন যাওয়া-আসার কোনো পথই নিষ্কণ্টক নয়, তবু এরা অদম্য, বলা যায় দুঃসাহসী, দুঃসাহসের পেছনে কী? পিতা শুকুর আলির শিক্ষা আর সামাজিক দায়বদ্ধতা। নিপাট ভদ্রলোক বিশ্বাস করতেন, নিজের মূলকে (রুটস্) ভুলে থাকা চলবে না, চোখ দুটো পেছনে নয়, সামনে। সমাজের সবাইকে জড়িয়েই এগোতে হবে, প্রথমে নিজেকে গড়তে হবে, নিজের নির্মাণে যদি দ্যুতি থাকে, তার অংশ আরো দশজনকে বিলিয়ে দেওয়া দরকার। সম্ভবত পিতার অঙ্কিত আদর্শে প্রাণিত হয়ে পরিবারটির তিন সদস্য শিক্ষকতা বেছে নিয়েছেন। এই নির্বাচনে ব্যক্তিগত পছন্দের চেয়ে সামাজিক মনোনয়নের জোর বেশি। দুই মেয়ের নাম আর কাজের মধ্যে কী অদ্ভুত সামঞ্জস্য। কামরুন মানে চন্দ্রমুখী, শামসুন সূর্যমুখী। চাঁদ আর সূর্য কীসের প্রতীক? নিশ্চিতভাবে অবারিত আলোর। অনালোকে তো বটে নির্বিশেষের যে কোনো চত্বরে কিরণ ছড়ায় সর্বমঙ্গলের উপগ্রহ আর নক্ষত্র। আমরা প্রত্যাশা পূরণের চিহ্ন দেখছি এই দুই মেয়ের অভিব্যক্তিতে। তাঁদের গবেষণার বিষয়কেও সমাজের পছন্দ আর হিতাকাঙ্ক্ষা ছুঁয়ে আছে। যিনি দর্শনের অধ্যাপক, তিনি বেছে নিয়েছেন ন্যায় ও যুক্তি। ইংরেজির কলেজ শিক্ষকের বিষয়, মিনিং (Meaning)। নীতি, অর্থ আর যুক্তির উত্স আর বিস্তারকে যাঁরা খুঁজছেন, তাঁদের ব্যক্তিক পছন্দকে সমষ্টির পছন্দের (Social Choice) বাইরে রাখা কি সম্ভব? মনে হয় না। দেবীপুরের হরিণডাঙার নিখাদ বিদ্যাদাতার দুই কন্যার কর্মে ও মর্মে কি বড় হয়ে উঠছে না সামাজিক মনোনয়নের সত্য? এ কীসের নির্দেশ? চরৈবেতির না কোরানের প্রথম উচ্চারণ— ইকরা’র—পাঠ কর, পড়তে থাক, নিজে পড়, অন্যদেরও শেখাও। এগোও, সমাজকে নিয়ে এগিয়ে চলো। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, সম্পাদক আরম্ভ পত্রিকা |