রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
গোলাম কবির
|
![]() সাধারণত মানুষ নিজের কালের সমাজজীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। আবার অনেকে পরচর্চা করে সুখ পায়। বক্তব্য অনুকূলে থাকলে শ্রোতাও সে সুখ ভাগ করে নেয়। তবে ভুল শুধরে দিয়ে নিজে সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে কজন? বাঙালির সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাভাবনাকে শুধু কাগজ-কলমে রূপ দেননি, হাতে-কলমেও দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার বিস্তারিত সন্ধানে যাব না। একটি মাত্র পত্রকে আলোচনার উপজীব্য হিসেবে উপস্থাপন করব। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দুই বছর পর ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভুবনডাঙ্গায় একটি ব্রহ্মাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে সেটি আশ্রম বিদ্যালয় ও পরে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। আজকের দিনে যার পরিচয় শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যেসব মতামত পোষণ করে গেছেন, আমরা তা ফিরে দেখব। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল অনেকটা মতবাদমুক্ত। জীবনকেন্দ্রিক বিষয়ের সেখানে প্রাধান্য ছিল। শুধু তাত্ত্বিক বা কেতাবি জ্ঞান নয়; হাতে-কলমে কিছু কর্মমুখী শিক্ষারও সংযোজন ছিল সেখানে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে। আমরা যে পত্রটি সম্পর্কে উল্লেখ করেছি তাকে তখনকার আশ্রম বিদ্যালয়ের অঘোষিত গঠনতন্ত্র মনে করা হতো। চিঠিখানা প্রখ্যাত পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর জামাই কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা। তিনি শান্তিনিকেতনের প্রথম দিককার নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ১২-১১-১৯০২ তারিখে তাঁকে দীর্ঘ ২০ পৃষ্ঠার একখানা পত্র লেখেন। পত্রের সূচনা করেন এভাবে, ‘আপনার প্রতি আমি যে ভার (শিক্ষকতার) অর্পণ করিয়াছি আপনি তাহা ব্রতস্বরূপ গ্রহণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, ইহাতে আমি বড় আনন্দ লাভ করিয়াছি। ’ লেখা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে বিশ্বাস করতেন, চাকরি হিসেবে নয়। এই শিক্ষাব্রতের কর্মযজ্ঞে প্রথম থেকেই শামিল ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল, ক্ষিতিমোহন সেন প্রমুখের মতো কর্মযোগী ব্যক্তিরা। বলা হয়ে থাকে জ্ঞানেই পরম আনন্দ। প্রাণহীন জ্ঞান আনন্দের হয় না। রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানকে আনন্দময় করার জন্য এমন সব শিক্ষক বেছে নিতেন, যাঁরা শিক্ষকতার জন্যই জন্মেছিলেন। তাঁরা ‘পড়া গিলাইবার কলমাত্র’ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে নির্মোহ ছিলেন। তিনি অশিক্ষককে শিক্ষাব্রতে নিয়োগ না করার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। তিনি মনে করতেন, ‘শিক্ষক পাওয়া যায়, গুরু পাওয়া যায় না। ’ আর গুরুর কাজ শিক্ষাদান, শিক্ষা কেনাবেচা নয়। এই দানকে পূর্ণ মাহাত্ম্য দিতে হলে শিক্ষককে ‘নিজের অযোগ্যতা স্মরণ করিয়া নিজেকে প্রত্যহ সাধনার পথে অগ্রসর করিতে হইবে। ’ আমরা উল্টো পথে চলছি। মতবাদের অনুগত, আত্মীয়তা বা অর্থকড়ির বিনিময়ে যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছি, তাদের কজনের ভেতর পাণ্ডিত্য ও ত্যাগের ব্রত আছে? আমরা খতিয়ে দেখি না। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই দেশপ্রেমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই দেশপ্রেম বহু প্রাচীন অনুভব। রবীন্দ্রনাথ অনেক আচরণের ক্ষেত্রে প্রাচীন পন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার্থীরা পাঠে মনোনিবেশের সঙ্গে সঙ্গে যেন নিবিড়ভাবে দেশপ্রেমের শিক্ষা লাভ করে। ওই একই পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘...ছাত্রগণকে স্বদেশের প্রতি বিশেষরূপে ভক্তি শ্রদ্ধাবান করিতে চাই। ’ তিনি ভাবতেন, ‘পিতামাতা যেমন দেবতা তেমনি স্বদেশও দেবতা। স্বদেশকে লঘুচিত্তে অবজ্ঞা, উপহাস, ঘৃণা—এমনকি অন্যান্য তুলনায় ছাত্ররা যাহাতে খর্ব করিতে না শেখে সেদিকে দৃষ্টি রাখিতে চাই। ’ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার একটা ক্ষুদ্র অংশ আমরা ফিরে দেখলাম। এই ফিরে দেখার উদ্দেশ্য, সেখান থেকে নেওয়া শিক্ষা যেন আমাদের জাতীয় শিক্ষা ও সমাজের হিতব্রতে কাজে লাগে। দুঃখের বিষয়, আমরা সম্মুখপানে ধেয়ে চলেছি অগ্র-পশ্চাত্ বিবেচনায় না এনে। বোঝার চেষ্টা করি না অতীতের মজবুত ভিতের ওপরই আগামী দিনের আলোকময় প্রভাত প্রতীক্ষমাণ। সেই প্রভাতে আমরা গেয়ে উঠব, ‘ধন্য হলো, ধন্য হলো মানবজীবন। ’
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ |